স্বাধীন দেশের বয়স তখন ৪৫ দিন। কিন্তু মিরপুর তখনও হয়ে আছে ঢাকার বুকে এক টুকরো পাকিস্তান।
স্বাধীনতার আগে থেকেই মিরপুরে প্রচুর বিহারী বাস করতো। ১৬ ডিসেম্বরের পর দলছুট পাক সেনারা সাদা পোশাকে এসে আশ্রয় নেয় এই এলাকায়। সাথে আগে থেকেই অবস্থান করা রাজাকাররাও ছিল। পাক সেনা, রাজাকার এবং বিহারীদের নিয়ে এই এলাকা রাষ্ট্রের ভেতর আরেক রাষ্ট্র হয়ে দাঁড়ায়।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রায় ২০ হাজার বিহারীকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে ‘সিভিল আর্মড ফোর্সেস’ (সিএএফ) নামের একটি বাহিনী গঠন করে। তাদেরও বড় অংশ ছিল মিরপুরে।
প্রচুর অস্ত্র থাকায় মিরপুর পরিণত হয় এক মিনি ক্যান্টনমেন্ট-এ। জেনেভা কনভেনশনের তোয়াক্কা না করে প্রতিদিনই সুযোগ পেলেই চালাতো বাঙালি হত্যা।
মিরপুরের সাথে বাইরের জগত ছিল প্রায় বিচ্ছিন্ন, ফলে গোয়েন্দা তথ্য আসে না বললেই চলে। যেকোনো যুদ্ধ শুরু করার আগে শত্রুর ভেতরকার খবর যেন এক এক টুকরো স্বর্ণ! দীর্ঘদিন ধরে মিরপুরে বাস করা বিহারিদের মিরপুরের জলাঞ্চল, জঙ্গল সবই নখদর্পণে। সবমিলে মিরপুর যেন এক দুর্ভেদ্য ঘাঁটি।
মিরপুর ১২, কালাপানি, মিরপুর সিরামিক্স, বর্তমান মিরপুর সেনানিবাস ছিল পাক-বিহারিদের মূল ঘাঁটি। ক্যাপ্টেন হেলাল মোর্শেদের নেতৃত্বে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তিন প্লাটুন সেনা মিরপুর মুক্ত করার জন্য আগ্রসর হয়।
মিরপুর মুক্ত করার জন্য যে ধরনের অভিযানের প্রয়োজন ছিল সেটাকে বলা হয় door to door fight। এ ধরনের অভিযানে শত্রু শহরের প্রত্যেকটা বাড়িতে অবস্থান করতে পারে। আক্রমণকারী বাহিনীকে পায়ে হেঁটে এবং ভারী কোনো সামরিক যান ছাড়াই প্রত্যেকটা বাড়িতে close quarters combat এর সম্মুখীন হতে হয়।
মিরপুর ১২ নম্বর দিয়ে আগ্রসর হচ্ছিল একটা দল। নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন লেফটেন্যান্ট সেলিম মোহাম্মদ কামরুল হাসান। ৩০শে জানুয়ারি সাড়ে এগারোটা নাগাদ হঠাৎই অ্যামবুশের ফাঁদে পড়েন তারা। আহত শরীর নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যান লেফটেন্যান্ট সেলিম। কভার ফায়ার দিয়ে অন্যদের নিরাপদ অবস্থানে যাবার সুযোগ করে দেন। কিন্তু নিজে আর নিরাপদ অবস্থানে আসতে পারেননি। আহত অবস্থায় বিহারীদের হাতে আটক হন তিনি। পরে বিহারীরা পৈশাচিক নির্যাতন করে হত্যা করে এই দুর্দান্ত অফিসারকে।
ধারণা করা হয় সেদিন বিহারীদের অ্যামবুশে ৪২ জন শহীদ হয়েছিলেন। ডি ব্লকে প্রবেশের সাথে সাথেই আশেপাশের সব বাড়ি থেকে হামলা শুরু করেছিল বিহারীরা। মিরপুর সাড়ে এগারোতে অবস্থান নেওয়া হাবিলদার বারকীর প্লাটুনেও হামলা হয়। সফলভাবে প্রতিহত করেন তারা। মিরপুর ১২ নম্বরের অস্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ির দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করে বিহারী বাহিনী। তুমুল যুদ্ধ হয় সেখানেও।
বিকেলে ভারী অস্ত্র দিয়ে মিরপুরের সব বিহারী অবস্থানে হামলা শুরু করে সেনাবাহিনী। ১২ নম্বর লক্ষ্য করে ৮১ মিলিমিটার মর্টার চার্জ করা হয়। অনুমান করা হয় প্রখ্যাত লেখক এবং নাট্যকার জহির রায়হানও এখানেই শহীদ হয়েছিল। তিনি তার নিখোঁজ ভাইকে খুঁজতে সেনাবাহিনীর সাথে মিরপুরের এসেছিলেন।
পরদিন সকালে থেকে পিছু হটা শুরু করে বিহারীরা। রাতের অন্ধকারের নিহত সেনাদের মৃতদেহ গুম করে ফেলা হয়। সেদিন প্রায় ৫০ জন নিহত হলেও মাত্র ৩-৪টি মৃতদেহ পাওয়া যায় পরে। মিরপুর ৩১শে জানুয়ারি মুক্তহলেও পবর্তী ১০দিন সেনাবাহিনীর তল্লাশি অভিযান চলে।
ছবিটি শহীদ লেফটেন্যান্ট সেলিম মোহাম্মদ কামরুল হাসান এর।
লেখা ও ছবি সূত্রঃ Roar Media